আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন দিন

জীবনযুদ্ধে জয়ী প্রতিকূলতা আর অভাবের বেড়া ভেঙে পুলিশ ও শিল্পী এবাদুল শুভর আলোকিত পথ

এবাদুল শুভ সমাজের একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার এবং কণ্ঠশিল্পী তার বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন
ছবি ঃ এবাদুল শুভ অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ

জীবন যেন এক চলমান নদীর মতো, যেখানে বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে অনেক কঠিন সময় আর অপ্রত্যাশিত মোড়। এই কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে যারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, যারা বাধা এলেও হাল ছাড়ে না এবং সেই স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে, তারাই আমাদের সমাজের আসল অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবন হয়ে ওঠে এক জীবন্ত উদাহরণ, যা অন্যদের পথ দেখায় এবং নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। বলছিলাম একজন সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং প্রতিভাবান মানুষ হলেন এবাদুল শুভ। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে অনেক অভাব আর পারিবারিক সংকটের মধ্যে, পড়াশোনাতেও তাঁকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই তাঁর স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাকে কেড়ে নিতে পারেনি। বরং, এই কঠিন সময়ের মাঝেই তাঁর ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা জেগে উঠেছে, বিশেষ করে গানের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা তাঁকে দিয়েছে এক ভিন্ন পরিচয়। তিনি একজন সৎ পুলিশ অফিসার, যিনি আইনের পোশাক পরে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তাঁর সততা আর নিষ্ঠা প্রবাদপ্রতিম। যখনই কেউ বিপদে পড়ে, তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে যায়, তিনি দিনরাত খেটে সেই হারানো ফোনগুলো উদ্ধার করে মালিকের মুখে হাসি ফোটান। শুধু বাস্তবেই নয়, ডিজিটাল জগতেও তিনি সক্রিয়। ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে আসা প্রতিটি মেসেজের উত্তর দেন, মানুষের ছোট-বড় সমস্যা মন দিয়ে শোনেন আর সাধ্যমতো সমাধানের পথ বাতলে দেন। তাঁর একটাই চেষ্টা ছিল—মানুষের ভালো করা। তবে দিনের আলোর এই কঠোর পুলিশ অফিসারের ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক ভিন্ন সত্তা—এক প্রতিভাবান শিল্পী। রাতের নিস্তব্ধতা বা অবসরের ফুরসতে তিনি ডুবে যেতেন সুর আর কথার জগতে। তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসত একের পর এক গান। শুধু লিখেই ক্ষান্ত হতেন না, নিজের লেখা গানে নিজেই সুর বসাতেন আর নিজেই গেয়ে উঠতেন। তাঁর তিনটি একক মৌলিক গান ইতিমধ্যেই শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে গেছে: "ভালোবাসি তোমায় আমি", "মন পিঞ্জরে বাইন্ধা রাখি", আর "ভুল মানুষ"। আর কিছুদিন পরেই আসছে তাঁর আরও একটি নতুন গান, যা নিয়ে তিনি ভীষণ আশাবাদী। তাঁর সৃষ্টি শুধু নিজের গানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর লেখা আর সুরে অনেক জনপ্রিয় শিল্পীও গান গেয়েছেন। কণ্ঠশিল্পী সোহাগের কণ্ঠে তাঁর লেখা ও সুর করা "লাল শাড়ি পড়িয়া কন্যা ৫" গানটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। কণ্ঠশিল্পী দীপ্ত, কণ্ঠশিল্পী সাব্বির রহমান—এমন আরও অনেক শিল্পী তাঁর কথায় ও সুরে নিজেদের কণ্ঠ মিলিয়েছেন। এছাড়াও, তাঁর লেখা ও সুর করা অসংখ্য ইসলামিক গজল রয়েছে, যা মানুষের মনে গভীর শান্তি এনে দিয়েছে এবং আলহামদুলিল্লাহ বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। শুভ'র এই পথ চলা শুধু সফল হওয়ার গল্প নয়, বরং এটি তাঁর দৃঢ় সংকল্প, অদম্য ইচ্ছা, নিজের ওপর বিশ্বাস এবং সৃজনশীলতার এক অসাধারণ উদাহরণ। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে, বাধাগুলো আসলে পথ বন্ধ করে দেয় না, বরং সঠিক মানসিকতা থাকলে তা নতুন পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে এবং মানুষকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তাঁর গল্প অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে দেখায়, কীভাবে জীবনের কঠিনতম সময়েও মেধা, মননশীলতা এবং দেশপ্রেমের মিশেলে নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি একজন গায়ক হিসেবে সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, তাঁর সংবেদনশীলতা এবং তাঁর মানবিক দিকটি ফুটিয়ে তোলে, যা তাঁকে করে তুলেছে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর এই দ্বৈত সত্তা তাঁকে সমাজের আরও গভীরে প্রবেশ করতে এবং মানুষের দুঃখ-কষ্টকে আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। এভাবেই এবাদুল শুভ তাঁর কর্ম ও গানের মাধ্যমে সমাজের জন্য এক ইতিবাচক বার্তা বহন করে চলেছেন, যা মানুষকে আশা জাগায় এবং ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করে।

এবার বিস্তারিত তথ্য জীবন বৃত্তান্ত।

শৈশব ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট

এবাদুল শুভ ছিলেন তাঁর পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। মা-বাবা এবং দুই ভাই-বোন নিয়ে তাঁদের ছোট পরিবার। শুভর ছোট বোন তাঁর চেয়ে মাত্র দুই বছরের ছোট হওয়ায়, তারা একই শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। দুজনই ছিলেন মেধাবী ছাত্র, এবং পড়াশোনার প্রতি তাঁদের প্রবল আগ্রহ পরিবারে আনন্দ এনে দিত। দীর্ঘ বিরতির পর, শুভর প্রায় ১২ বছর পর তাঁর ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়। পারিবারিক সচ্ছলতা তখনো ছিল এবং জীবন বেশ ছন্দেই কাটছিল।


এই সময়ে তাঁদের জীবনে এক নতুন মোড় আসে, যখন শুভ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এক বছর মাদ্রাসায় পড়ার পর তিনি আবার মূলধারার শিক্ষায় ফিরে আসেন এবং স্কুলে ভর্তি হন। তবে এবার তিনি তাঁর ছোট বোনের এক ক্লাস নিচে ভর্তি হন, যা ছিল তাঁর শিক্ষাজীবনের একটি ছোট বিচ্যুতি।


সংগ্রামের সূচনা: বাবার অসুস্থতা ও জীবনযুদ্ধ

পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে যখন শুভ সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাঁর জীবনে নেমে আসে এক চরম সংকট। তাঁর বাবা যক্ষ্মা (তখন যা টিবি রোগ নামে পরিচিত ছিল) রোগে আক্রান্ত হন। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অসুস্থতা তাঁদের আর্থিক অবস্থাকে একেবারে ভেঙে দেয়। শুভর পরিবার এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ে।


এই সময়টা শুভর জন্য ছিল চরম চ্যালেঞ্জের। একজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র হয়েও তিনি পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। দিনের কিছু অংশ তিনি অন্যের জমিতে কাজ করতেন, আর বাকি সময়টা নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট বোনের পড়াশোনাও চালিয়ে যেতেন। তাঁর এই ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফলে তিনি সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন, যা ছিল তাঁর দৃঢ় মানসিকতার এক বড় প্রমাণ।


পড়াশোনার পথে অবিরাম যাত্রা

বাবার অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা এবং নিজের প্রথম বিভাগ প্রাপ্তি শুভর জীবনে নতুন আশার সঞ্চার করে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর বাবাও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও আগের চেয়ে ভালো হতে শুরু করে। শুভ পড়াশোনা চালিয়ে যান। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) উভয় পরীক্ষাতেই তিনি দারুণ ফল করেন, যা তাঁর মেধা ও পরিশ্রমের ফসল।


তবে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল কিছুটা আশানুরূপ না হলেও, তিনি হতাশ হননি। বরং নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দেন। এরপর তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি স্বনামধন্য কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।


পুলিশে যোগদানের স্বপ্ন ও প্রথম পদক্ষেপ

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমিস্টারে পড়াশোনা করার সময় এবাদুল শুভ জানতে পারেন, বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে জন্ম নেয়। তিনি তাঁর দুই বন্ধু ইমরান এবং স্বপনকে সঙ্গে নিয়ে আবেদন করেন। শারীরিক মাপযোগের দিন, শুভ এবং ইমরান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু স্বপন বাদ পড়ে যান। এই প্রাথমিক সাফল্য শুভর আত্মবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তোলে।


স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলা

শারীরিক মাপযোগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর এবাদুল শুভ এবং ইমরান পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই ধাপগুলোতে সাধারণত লিখিত পরীক্ষা, মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা এবং কঠোর শারীরিক অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত থাকে। শুভর দৃঢ় মনোবল এবং তাঁর শৈশবের প্রতিকূলতা মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তাঁকে এই ধাপগুলো অতিক্রম করতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি জানতেন, দেশের সেবা করার এই সুযোগ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাঁর মনে ছিল, অভাবের মধ্যে যখন তিনি অন্যের খেতে কাজ করেছেন, তখনো তিনি পড়াশোনা ছাড়েননি। সেই একই স্পৃহা নিয়ে তিনি পুলিশের কঠিন প্রশিক্ষণগুলো সম্পন্ন করতে প্রস্তুত ছিলেন।


এবাদুল শুভর কাছে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান কেবল একটি চাকরি ছিল না, এটি ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর আত্মমর্যাদার প্রতীক এবং তাঁর পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর এক নতুন সুযোগ। তিনি জানতেন, তাঁর এই যাত্রা অসংখ্য তরুণকে অনুপ্রাণিত করবে, যারা প্রতিকূলতার মাঝেও স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে।


পুলিশ জীবন এবং ভবিষ্যৎ

বর্তমানে এবাদুল শুভ বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য। তাঁর শৈশবের অভিজ্ঞতা তাঁকে মানুষের কষ্ট বুঝতে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। তাঁর এই পেশা কেবল একটি দায়িত্ব নয়, এটি তাঁর সেবার মানসিকতার প্রতিফলন। তিনি সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, অপরাধ দমনে এবং মানুষের পাশে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই প্রমাণ করে, সঠিক মানসিকতা এবং পরিশ্রম থাকলে যেকোনো বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব।


এবাদুল শুভর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের ভেতরের শক্তি কতটা বিশাল হতে পারে। তাঁর এই যাত্রা কেবল শেষ হয়নি, বরং এটি নতুন প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যারা দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে চায়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন